নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীতে হঠাৎ করে বাসা বাড়ির বিদ্যুৎ বিল কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবার অভিযোগ এসেছে। এই অভিযোগকে পুরোপুরি অস্বীকার করে নি কর্তৃপক্ষ। তাদের মতে করোনাকালীন সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের কর্মীরা মিটার দেখে বিল করতে পারেন নি। যে কারণে কিছু জায়গায় সমস্যা হতে পারে বলে ধারণা তাদের। কিন্তু এই সমস্যা বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে খুব বড় হয়ে ধরা দিয়েছে সাধারণ নগরবাসীর কাছে। যে কারণে তারা প্রতিবাদে রাস্তায় পর্যন্ত নেমেছে। বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার বেশিরভাগ জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। তাদের দুটি বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্রের আওতায় নগরীর এক লক্ষ পনেরো হাজার গ্রাহক। গত ফেব্রুয়ারী থেকে সর্বশেষ মে মাসের বিল নিয়ে নানা অভিযোগ করেছে এইসব গ্রাহকেরা।
তবে ওজোপাডিকোর স্থানীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন যারা যারা অভিযোগ নিয়ে তাদের অফিসে এসেছেন তাদের সমস্যা সুরাহার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষাধিক গ্রাহকের মধ্যে কতজন ওজোপাডিকোর অফিস পর্যন্ত অভিযোগ নিয়ে যেতে পেরেছে আর কতজনই বা সরকারি কাজের দীর্ঘসূত্রিতা সহ্য করে নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে সে হিসেব দিতে পারে নি কেউ। নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোঃ ইউসুফ হাওলাদার। একটি বেসরকারি কলেজে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ওজোপাডিকো বরিশালের ২ নং বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্রের দীর্ঘদিনের গ্রাহক। গত কয়েকবছর যাবৎ তাঁর মাসিক বিদ্যুৎ বিল আসে দুইশো থেকে তিনশো টাকার মধ্যে। কিন্তু সর্বশেষ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে তাঁর বিল এসেছে চারশো টাকার উপরে।
তিনি নিশ্চিত করেছেন এই সময়ে তাঁর বাড়িতে নতুন কোন ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহার করা হয় নি যাতে বিল বাড়তে পারে। বরঞ্চ করোনাকালীন সংকটের সময়ে বিদ্যুৎ বিল কমানোর জন্য প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ঘরের লাইট কিংবা ফ্যান প্রায়ই বন্ধই রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ছোট একটা চাকরি করি ভাই। বিল বেশি কেন এসেছে সে প্রশ্ন বড় সরকারি কর্মকর্তাকে করার সাহস নেই। তাই করোনায় আর্থিক নানা সমস্যায় থাকলেও ঝামেলা এড়াতে প্রতিমাসে দ্বিগুণ হারে বিল পরিশোধ করেছি। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোঃ মোশাররফ হোসেন। তিনি ওজোপাডিকো বরিশালের ১ নং বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্রের গ্রাহক। সাধারণ সময়ে তার বাড়িতে প্রতিমাসে এক হাজার থেকে বারোশত টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে। চলতি সপ্তাহের বুধবার তিনি হাতে গত কয়েকমাসের বিল একসঙ্গে পান। কিন্তু সাধারণ সময়ের চেয়ে তাঁর এবারের বিল এসেছে কয়েকগুণ বেশি। তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারি তে বারোশত আটান্ন টাকা বিল এসেছিলো যা পরিশোধ করেছি। গত তিনমাস বিলের কোনো কাগজ পাই নি। বুধবার হঠাৎ আমার পরিশোধ করা ফেব্রুয়ারি মাসের বিল সহ চারমাসের বিল একসঙ্গে দিয়ে গেছে। সেখানে বিলের যে পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে তা বিগত মাসগুলোর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
একই এলাকায় মেস ভাড়া করে অন্য চারজন সহ বসবাস করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুপর্ণা দাশ। তিনি আরো ভুতুড়ে বিষয় সামনে আনেন। তিনি জানান, গত মার্চ মাসে তাদের বিদ্যুৎ বিল এসেছিলো ১৩০০ টাকা। করোনাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় ঐ মাসের শেষের দিকে মেসের সবাই যে যার বাড়িতে চলে যান। পরবর্তী পুরো মাসজুড়ে মেসের সমস্ত ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র এবং লাইট-ফ্যান বন্ধ ছিল। কিন্তু পরের মাসে ২৮৫৪ টাকার বিল দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ। তিনি বলেন, মেসে কেউ না থাকলেও এবং কোনো প্রকার বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেও কিভাবে বিগত মাসের চেয়ে এপ্রিল মাসে দিগুণের বেশি বিল আসে তা বোধগম্য নয়।
বরিশাল ওজোপাডিকোর বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্র-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অমূল্য কুমার সরকার জানান, গত এপ্রিল-মে মাস জুড়ে করোনা পরিস্থিতি খারাপ থাকায় তাদের লোকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার রিডিং (পরীক্ষা) করে বিল করতে পারেন নি। এ কারণে কিছু ভুল হতে পারে। কিন্তু যারাই বিলের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন তাদের বিষয়ে সমাধানমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এই কর্মকর্তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন এখানকার ওজোপাডিকো বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্র- ১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আমজাদ হোসেন। তিনি আরো বলেন, আমার মাঠকর্মী (লাইনম্যান) ২০ জন। তারাই সাধারণত মিটার রিডিং এর কাজ করেন। কিন্তু সাধারণ বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ করতে গিয়ে তাদের অধিকাংশ করোনা উপসর্গ নিয়ে আইসোলেশন (সঙ্গরোধ) অবস্থায় বাড়িতে আটকে পড়েছেন। জনবল সংকটের কারণে যেভাবে বিল করার কথা সেভাবে করার উপায় ছিল না। যে কারণে মিটার রেটিং ধারণা করে বিল করতে গিয়ে কিছু সমস্যা হতে পারে।
এ ধরনের ভুতুড়ে বিল প্রত্যাহার করাসহ আরো কিছু দাবি নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখা। এই কর্মসূচিতে ভুতুরে বিদ্যুৎ বিলের ভুক্তভোগী অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন। সংগঠনটির আহবায়ক ইমরান হাবিব রুমন জানান, একজন গ্রাহকের এক মাসে যে বৈদ্যুতিক বিল আসে সেটা হঠাৎ করে পরের মাসে দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু বরিশাল শহরে এমন উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে গত কয়েকমাস ধরে। করোনাকালীন সময়ে যেখানে সরকারের উচিত মানুষের এ ধরনের খরচ থেকে মুক্তি দেয়া সেখানে এই ঘটনা সাধারণ মানুষদের রক্ত চোষার সামিল। তাই আমরা দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের আশায় প্রতিবাদ জানিয়েছি। তিনি আরো উল্লেখ করেন, যদি বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো গাফিলতি কিংবা মুনাফালোভী মনোভাবের কারণে সাধারণ জনগণের এই সমস্যা সৃষ্টি হয় তবে তাদেরকে দ্রুত শুধরে যাবার আহবান জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে যদি সাধারণ মানুষদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের ঘটনার ফয়সালা না হয় তবে আমরা চুপ করে বসে থাকবো না। তিনি বলেন, কয়েকদিনের মধ্যে বরিশালের মানুষদের বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে যে সকল প্রতিষ্ঠান জড়িত তারা যদি সাধারণ মানুষদের স্বস্তিতে থাকার ব্যবস্থা না করে তবে তাদের অফিস ঘেরাও সহ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
Leave a Reply